পরবর্তী ব্রিকস সম্মেলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় থাকবে ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি। আগামী আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিতব্য ওই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো নিজেদের বাণিজ্যিক পরিশোধ কিভাবে স্থানীয় মুদ্রায় করবে এ নিয়ে আলোচনা হবে। ফলে শুধু বেইজিং আর মস্কো নয়, ভারত থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও এখন স্থানীয় মুদ্রার ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলার শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তাই বিশেষত রাশিয়া ও চীন এ মুদ্রা থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন থেকে চালিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক এ চেষ্টায় অন্যান্য দেশও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হচ্ছে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের জুলিয়াস সেন বলেন, ‘ডলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ফলে যে দেশ টার্গেটে পরিণত হয় সেই দেশটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে এটি সবার জন্যই ক্ষতিকর।’
এমনকি রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবেও ডলারের অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। ২০০০ সালে যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রিজার্ভ মুদ্রার ৭০ শতাংশ ছিল ডলার, এখন তা কমে ৬০ শতাংশের নিচে নেমেছে। ব্রিটিশ ব্রোকার ক্যাপিটাল ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে বিশ্বে রিজার্ভ মুদ্রার ৫৮.৩৬ শতাংশ ছিল ডলার। ২০.৪৭ শতাংশ ছিল ইউরো, ৫.৫১ শতাংশ পাউন্ড স্টার্লিং, ৪.৯৫ শতাংশ জাপানি ইয়েন, ২.৬৯ শতাংশ চীনা ইউয়ান, ২.৩৮ শতাংশ কানাডিয়ান ডলার, ১.৯৬ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ান ডলার, ০.২৩ শতাংশ সুইস ফ্রাঁ এবং ৩.৪৫ শতাংশ অন্যান্য মুদ্রা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যে পরিমাণ ঋণ দাঁড়িয়েছে তাতে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যেকোনো সময় আর্থিক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এ অবস্থায় অনেক দেশই আর্থিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে ডলারমুক্ত লেনদেনে ঝুঁকছেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব বছরে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব সংগ্রহ করেছে তার চেয়ে ৭২৩ বিলিয়ন ডলার বেশি ব্যয় করেছে। ফলে দেশটির রাজস্ব ঘাটতি আরো বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জাতীয় ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩১.৪৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ বলে অর্থনীতিবিদরাই বলছেন।
এ ক্ষেত্রে ডলারের বিকল্প মুদ্রা হিসেবে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে চীনের ইউয়ান। কিন্তু চীনের আবদ্ধ অর্থনীতির ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এ বাজারে প্রবেশ অনেক কঠিন।
এ বিষয়ে জাপানের কিইও ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক মাসায়া সাকুরাগাওয়া বলেন, ‘ইতিহাসের দিকে তাকালে বুঝতে পারবেন মুদ্রার প্রাধান্যের যে প্রবণতা তা বদলে গেছে একটি বড় যুদ্ধের পর। যেমন ডলার বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে অবস্থান তৈরি করেছে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল প্ল্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপকে সহযোগিতা করেছে। একইভাবে যুদ্ধের পর চীনও রাশিয়াকে সহযোগিতার মাধ্যমে ইউয়ানকে শক্তিশালী করতে পারে।’
প্রসঙ্গত, ১৯৪৪ সালে ৪৪টি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে একটি চুক্তি করে। সিদ্ধান্ত হয়, এসব দেশের মুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের ওপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হয় তখন সোনার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুদ করা সোনার ৭০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিপুল সোনা মজুদ এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় সেসব দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়। মূলত ডলারের আধিপত্য সেই থেকে শুরু।
সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড, আলজাজিরা।